বিশাল আকারের জাহাজ কীভাবে পানিতে ভেসে থাকে?
বিশাল আকারের জাহাজ কীভাবে পানিতে ভেসে থাকে?
বিশাল আকারের জাহাজ কীভাবে পানিতে ভেসে থাকে, সেটা একটা খুবই মজার বিজ্ঞানের প্রশ্ন। লোহার তৈরি জাহাজ, এত বড় হয়েও পানিতে ডুবে না কেন?
এর পেছনে বিজ্ঞানের একটা সুন্দর কারণ আছে। কারণটা হল:
✏️ আর্কিমিডিসের সূত্র: এই সূত্র অনুযায়ী, কোনো বস্তুকে যখন কোনো তরলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়, তখন বস্তুটি তার ওজনের সমান পরিমাণ তরলকে সরিয়ে দেয়। আর এই সরানো তরলের ওজনই বস্তুটিকে উপরে তাড়িয়ে দেয়।
✏️ জাহাজের আকার ও গঠন: জাহাজের ভেতরে অনেক খালি জায়গা থাকে। এই খালি জায়গাগুলোতে হাওয়া থাকে। ফলে জাহাজের মোট ওজন কম হয় এবং জাহাজের যে পরিমাণ জল সরিয়ে দেয়, তার ওজন জাহাজের মোট ওজনের চেয়ে বেশি হয়। এই কারণেই জাহাজ পানিতে ভাসে।
✏️ জাহাজের আকৃতি: জাহাজের আকৃতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাহাজের নিচের অংশ বেশি চওড়া হয় যাতে এটি আরো বেশি জল সরিয়ে দিতে পারে।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে:
ধরো, তুমি একটা প্লাস্টিকের পাত্রে পানি ভরে নিয়েছ। এবার সেই পাত্রে একটা কাঠের টুকরা ফেলে দাও। কাঠের টুকরাটা পানির উপর ভাসবে। কারণ কাঠের টুকরা যে পরিমাণ পানি সরিয়ে দেয়, তার ওজন কাঠের টুকরার ওজনের চেয়ে বেশি।
তাহলে বুঝতে পারছ, বিশাল আকারের জাহাজ কীভাবে পানিতে ভাসে? এর আকার, গঠন এবং আর্কিমিডিসের সূত্র মিলেমিশে জাহাজকে পানির উপর ভাসিয়ে রাখে।
জাহাজের বিভিন্ন অংশের নাম কি?
একটি জাহাজ অনেকগুলো বিভিন্ন অংশ দিয়ে গঠিত। প্রতিটি অংশের নিজস্ব কাজ রয়েছে এবং জাহাজের সামগ্রিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এখানে জাহাজের কিছু প্রধান অংশের নাম উল্লেখ করা হলো:
জাহাজের বহিঃস্থ অংশ:
ধড় (Hull): জাহাজের মূল কাঠামো, যা পানিতে ভাসার জন্য ডিজাইন করা।
কিল (Keel): জাহাজের নিচের অংশে একটি দীর্ঘ, তীক্ষ্ণ অংশ যা জাহাজকে স্থিতিশীল রাখে।
স্টার্ন (Stern): জাহাজের পেছনের অংশ।
বাউ (Bow): জাহাজের সামনের অংশ।
পোর্টহোল (Porthole): জাহাজের দেয়ালে ছোট ছোট গোলাকার খোলা যার মাধ্যমে আলো এবং বাতাস প্রবেশ করে।
ডেক (Deck): জাহাজের মেঝে, যা বিভিন্ন তলায় থাকতে পারে।
সুপারস্ট্রাকচার (Superstructure): জাহাজের উপরের অংশ যেখানে ক্যাবিন, ব্রিজ ইত্যাদি অবস্থিত।
জাহাজের অভ্যন্তরীণ অংশ:
ব্রিজ (Bridge): জাহাজ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র। এখান থেকে জাহাজের গতিপথ, গতিবেগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ইঞ্জিন রুম (Engine room): জাহাজের ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি অবস্থিত।
কার্গো হোল্ড (Cargo hold): মালবাহী জাহাজে মাল পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত জায়গা।
ক্যাবিন (Cabin): যাত্রীদের থাকার জন্য ব্যবহৃত কক্ষ।
গ্যালি (Galley): জাহাজের রান্নাঘর।
স্টোরেজ রুম (Storage room): বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখার জন্য ব্যবহৃত কক্ষ।
অন্যান্য অংশ:
প্রোপেলার (Propeller): জাহাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত একটি ব্লেডযুক্ত যন্ত্র।
রুডার (Rudder): জাহাজের দিক পরিবর্তন করার জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র।
মাস্ট (Mast): জাহাজে লাগানো একটি উঁচু কাঠামো যার উপর পতাকা, আলো ইত্যাদি লাগানো হয়।
বোট (Boat): জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকা।
এ ছাড়াও জাহাজের বিভিন্ন ধরনের উপর নির্ভর করে এর অংশের নামকরণও ভিন্ন হতে পারে।
জাহাজ কীভাবে চলাচল করে?
জাহাজ চলার পেছনে বিজ্ঞানের একটা মজার খেলা লুকিয়ে আছে। তুমি জানো, বিশাল আকারের লোহার জাহাজ এত সহজে পানিতে ভাসে কেন? এর পেছনে আছে আর্কিমিডিসের সূত্র।
কীভাবে জাহাজ চলে তা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে:
* প্রোপেলার: জাহাজের পেছনে একটি বড় পাখার মতো যন্ত্র থাকে, যাকে প্রোপেলার বলে। ইঞ্জিনের শক্তি এই প্রোপেলারকে ঘোরাচ্ছে। প্রোপেলার ঘুরতে ঘুরতে পানিকে পেছনে ঠেলে দেয়। এই ঠেলায় জাহাজ সামনে দিকে এগিয়ে যায়।
* রুডার: জাহাজের দিক পরিবর্তন করতে রুডার ব্যবহার করা হয়। রুডার একটা বড় পালকের মতো যন্ত্র, যা প্রোপেলারের পেছনে থাকে। রুডারকে ডানে বা বাঁয়ে ঘুরিয়ে জাহাজের দিক পরিবর্তন করা হয়।
* ইঞ্জিন: জাহাজের হৃদয় হচ্ছে ইঞ্জিন। ইঞ্জিন প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করে, যা প্রোপেলারকে ঘোরায় এবং জাহাজকে চালায়। আজকালের বড় জাহাজগুলোতে সাধারণত ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।
সহজ করে বললে:
* ইঞ্জিন শক্তি উৎপন্ন করে।
* শক্তি প্রোপেলার কে ঘোরায়।
* প্রোপেলার পানিকে পেছনে ঠেলে দেয়।
* এই ঠেলায় জাহাজ সামনে এগিয়ে যায়।
* রুডার দিয়ে জাহাজের দিক পরিবর্তন করা হয়।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে:
তুমি কোনো একটা ছোট নৌকা নিয়ে পানিতে ভাসছ। তুমি যদি পানিতে একটা লাঠি দিয়ে পেছনে ধাক্কা দাও, তাহলে নৌকা সামনে দিকে যাবে। জাহাজও ঠিক একইভাবে কাজ করে। প্রোপেলার পানিকে পেছনে ধাক্কা দিয়ে জাহাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।
জাহাজগুলো ঝড় বা তুফান কীভাবে মোকাবেলা করে?
বিশাল জাহাজগুলো ঝড় বা তুফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরাপদে টিকে থাকে। এর পেছনে আছে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের যৌথ প্রচেষ্টা। আসুন জেনে নিই কীভাবে:
✏️ জাহাজের গঠন: আধুনিক জাহাজগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ইস্পাত দিয়ে তৈরি। এগুলোকে ঝড়ের ঢেউ ও বাতাসের চাপ সহ্য করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়। জাহাজের ধড় (hull) খুব শক্তিশালী হয় এবং এটিতে জাহাজকে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে এমন কাঠামো থাকে।
✏️ বাল্লাস্ট ট্যাঙ্ক: জাহাজের ভিতরে বাল্লাস্ট ট্যাঙ্ক থাকে। এই ট্যাঙ্কে জল ভরে জাহাজের ওজন বাড়ানো যায় এবং ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। ঝড়ের সময় এই ট্যাঙ্কগুলোর জলের পরিমাণ পরিবর্তন করে জাহাজকে স্থিতিশীল রাখা হয়।
✏️ আবহাওয়া পূর্বাভাস: আধুনিক জাহাজগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকে যার মাধ্যমে জাহাজের ক্যাপ্টেনরা ঝড়ের বিষয়ে আগেই জানতে পারেন। এতে করে তারা জাহাজকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন বা ঝড়ের প্রভাবে কম এমন একটি রাস্তা বেছে নিতে পারেন।
✏️ অভিজ্ঞ নাবিক: জাহাজ চালানোর জন্য অভিজ্ঞ নাবিকদের প্রয়োজন। তারা ঝড়ের সময় জাহাজকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা জানেন। তারা জাহাজের ইঞ্জিন, রুডার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জাহাজকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করেন।
✏️ শক্তিশালী যন্ত্রপাতি: আধুনিক জাহাজগুলোতে শক্তিশালী ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি থাকে যা ঝড়ের সময়ও কাজ করতে সক্ষম। এই ন্ত্রপাতি জাহাজকে সঠিক দিকে চালানো এবং ঝড়ের প্রভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য সাহায্য করে।
যদিও জাহাজগুলো ঝড় মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকে, তবুও সমুদ্রের অবস্থা খুব খারাপ হলে জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ঝড়ের সময় সমুদ্রে যাত্রা করা খুবই বিপজ্জনক।